
এ পর্যায়ে আপিল বিভাগের জনাকীর্ণ এজলাস কক্ষে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি সংক্ষিপ্তভাবে রায় ঘোষণা করেন। বিচারপতিরা এজলাস কক্ষে আসার আগেই উভয়পক্ষের আইনজীবী, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কানায় কানায় ভরে যায় এজলাস কক্ষ। তিল ধারণের ঠাঁই ছিলনা এজলাস কক্ষে।
একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণের মতো অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়ার সাড়ে ৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে সুপ্রিমকোর্টে এ মামলার আপিল শুনানি শেষ হয় গত ২৩ জুলাই। ওইদিনই প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির বেঞ্চ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন।এরপরই প্রায় দেড় মাসের দীর্ঘ অবকাশকালীন ছুটিতে যায় সুপ্রিমকোর্ট। ছুটি শেষে গত ১৫ সেপ্টেম্বর খোলা হয় সুপ্রিমকোর্ট। এই দীর্ঘ সময় কাঙ্খিত রায়ের অপেক্ষায় ছিলেন গোটা জাতি।
২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয় ট্রাইব্যুনাল-২। রায়ে বলা হয়, এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে আনা ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং একটি রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেননি। এর মধ্য দুটি অভিযোগে মিরপুরের আলোকদী গ্রামে গণহত্যা এবং অন্য এক ঘটনায় হযরত আলী লস্করসহ তার স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা এবং লস্করের মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পরও কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়। আর দুটি অভিযোগে দেয়া হয় ১৫ বছর কারাদ-।
ওই রায়ের পর কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে সারাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হলে সরকার আইন সংশোধন করে আপিলের ক্ষেত্রে প্রসিকিউশন ও আসামি- উভয় পক্ষের সমান সুযোগ তৈরি করে। অবশ্য আগে প্রসিকিউশন শুধু খালাসের ক্ষেত্রে এবং আসামিপক্ষ সব ক্ষেত্রেই আপিল করার সুযোগ ছিল।
আইন সংশোধনের পর রায়ের এক মাসের মধ্যে উভয়পক্ষই ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। আপিলে কাদের মোল্লা বেকসুর খালাস চান। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণিত অভিযোগগুলোতে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ দ-ের পাশাপাশি খালাস পাওয়া অভিযোগে ন্যায় বিচার চায়। আপিলের পর বেশ কিছু পদ্ধতিগত কাজ শেষে গত ১ এপ্রিল এই মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়। এর আগেই কাদের মোল্লার মামলা শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগে গঠন করা হয় পৃথক বেঞ্চ।
প্রথম দিকে ওই বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ছিলেন। তবে বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া অবসরে যাওয়ায় জুন মাস থেকে ৫ বিচারপতি নিয়েই চলছে এই বেঞ্চ। কাদের মোল্লার এই মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা ৪০ দিনের মতো নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। কিন্তু শুনানির এক পর্যায়ে কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সংশোধিত আইন প্রযোজ্য হবে কি না ও এই বিচারে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আসামিপক্ষ।
এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তার জন্য গত ২০ জুন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র সাত আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন প্রধান বিচারপতি। এরপর সাত অ্যামিকাস কিউরির মতামত শোনেন আপিল বিভাগ। সাত অ্যামিকাস ছাড়াও রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আসামিপক্ষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক শুনানি করেন।
সাত অ্যামিকাস কিউরি হলেন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, টি এইচ খান, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বক্তব্যের মাধ্যমে গত ৮ জুলাই অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য নেয়া শুরু হয়। ২২ জুলাই বক্তব্য শেষ হয়।
অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে রফিক-উল হক, আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, আজমালুল হোসেন ও রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, সংশোধিত আইন কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। তবে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ ও টি এইচ খান ভিন্ন মত পোষণ করেন। তারা বলেন, আইন সংশোধনের আগে রায় হওয়ায় সংশোধিত আইন কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।