নিউজবাংলা২৪ডটনেট:: দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার অবশেষে ফাঁসি কর্যকর হলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ আজ বৃহষ্পতিবার রাতে কার্যকর করা হয়। এর আগে সকালে রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর ফাঁসির প্রস্তুতি শুরু করে কারা কর্তৃপক্ষ। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের দ্রুত কারাগেটে ডাকা হয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ তিনি কথা বলেন। এরপরই রাত ১০টা একমিনিটে ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আজ সন্ধ্যা থেকেই গণমাধ্যম মোটামুটি নিশ্চিত হয় যে, রাতেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। প্রায় সাড়ে তিনশ’ মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যায় অভিযুক্ত কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকর করার আগে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয় সারাদেশে। জেলখানাকে রাখা হয় কঠোর নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে। রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসি দেয়া হবে— এ খবর ছড়িয়ে পড়লে পুরান ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে হাজার হাজার মানুষের স্রোত নামে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে এলাকা প্রকম্পিত করে তারা। স্বাধীনতা বিরোধী এক জঘন্য অপরাধীর ফাঁসির রায়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী সমর্থকরা। দেশে বিদেশে লাখ কোটি দর্শক শ্রোতা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখেন। আইজি প্রিজন ছাড়াও ঢাকার জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট, সিভিল সার্জন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এদিকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কারাগার এলাকায় নিরাপত্তা আরো নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কারাগারের চারপাশে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত র্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রাতে রায় কার্যকরের কয়েক ঘন্টা আগে কাদের মোল্লাকে বিষয়টি অবহিত করা হয়। কারা কর্তৃপক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় রাতে তিনি কি খাবার খেতে চান এবং ফাঁসির বিষয়টি তার পরিবারের সদস্যদের আগে থেকে জানানো হবে কি-না। জবাবে তিনি স্বাভাবিক খাবারের কথা বলেন। তিনি কারা কর্তৃপক্ষকে জানান, ফাঁসি কার্যকরের আগেই যেন বিষয়টি তার পরিবারকে জানানো হয়। কারাগার সূত্র জানায়, ফাঁসির মঞ্চে নেয়ার সময় কাদের মোল্লাকে ভাবলেশহীন দেখাচ্ছিল। এর আগে তিনি নফল নামাজ পড়েন, রীতি অনুযায়ী তওবা পাঠ করেন। পরে তাকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। তাকে পরানো হয় জমটুপি। এরপর ফাঁসির রজ্জুতে (ম্যানিলা রোপ) ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সেখানে উপস্থিত একজন চিকিত্সক কাদের মোল্লার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর তার লাশ ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানো হয়। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করতে দুইজন কয়েদি জল্লাদকে নিয়োগ দেয়া হয়। কারা সূত্রে জানা গেছে, ফাঁসি কার্যকর করার আগে কয়েক দফায় ফাঁসির মঞ্চের রশি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন কারা কর্মকর্তারা। রশিতে পাকা কলা মাখানো হয়েছে। যে পাটাতনটির উপর কাদের মোল্লাকে দাড় করানো হয়েছিল সেই পাটাতন কয়েক দফায় চেক করা হয়েছে। পাটাতন ও রশির কপিকল গুলোতে বিশেষ তৈল দেয়া হয়েছে। ফাঁসি কার্যকর করতে আগেই আনা হয় বিশেষ লাল রুমাল। ফাঁসির আগে একজন উর্ধতন কারা কর্মকর্তা হাত থেকে রুমাল ফেলে দেয়ার কসরত করছেন। এদিকে দুইজন ম্যাজিষ্ট্রেট বিকেলে কারা মহাপরিদর্শকের সঙ্গে সাক্ষা করেছেন। কিভাবে ফাঁসি কার্যকর হবে তা বিস্তারিত বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের আগে কারাগারের ভেতর ও বাইরে ছিল কড়া নিরাপত্তা। পুরো কারাগার ঘিরে রেখেছিল গোয়েন্দারা। সন্ধ্যার আগে থেকেই কারাগার এলাকার সব সড়ক ও দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়। র্যাব ও আর্মড পুলিশ পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়। কাদের মোল্লা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেনি। কারা সূত্র জানায়, ফাঁসির মঞ্চে ব্যবহারের জন্য গত মঙ্গলবার সকালে মিরপুর থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সেগুন কাঠের ৯ ফুট, ৬ ফুট ও ৪ ফুট দৈর্ঘ্যের চার টুকরা তক্তা আনা হয়। ফাঁসির মঞ্চে এই কাঠের টুকরাগুলোর ওপরই তাকে দাঁড় করানো হয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক ট্র্যাইব্যুনাল-২ একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় জায়ামাতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র এবং আসামি উভয়পক্ষ আপিল করে। গত ১৭ সেপ্টম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড দেয়। ৯৭০ পৃষ্ঠার সেই রায়ের পূর্নাঙ্গ কপি বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হয়। এরপর মঙ্গলবার রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেয় সরকার। ওই রাতেই আপিল বিভাগের চেম্বার জজের কাছে আবদেন করে কাদের মোল্লার আইনজীবীরা। পরে দুই দিন শুনানির পর আজ আবেদন খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। এর আগে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয় কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ ৬ জঙ্গির ফাঁসি দেয়া হয় কুমিল্লা, কাশিমপুর, ময়মনসিংহ ও রংপুর কারাগারে। এর মধ্যে কুমিল্লায় শায়খ আবদুর রহমান, ময়মনসিংহ কারাগারে সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই ও আবদুল আউয়াল, পাবনায় খালেদ সাইফুল্লাহ, কাশিমপুর কারাগারে আতাউর রহমান সানি ও ইফতেখার হাসান মামুন। ময়মনসিংহ কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করার সময় বাংলাভাইয়ের (শরীরের ওজন বেশি হওয়ার কারণে) গলা ছিঁড়ে যায়। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মস্তক। ২০০৭ সালের শেষ দিকে ফাঁসি কার্যকর করা হয় নারায়ণগঞ্জের আলোচিত মাম্মী হত্যা মামলায় তার স্বামী রিপনের।